আমরা অনেক সময় মুখ ফসকে বলেই ফেলি “আমাদের রাজনীতিতে ভাল লোক কেউ আছে নাকি!”। ঢালাওভাবে এই কথাটা আমার কাছে খুবই খারাপ লাগে। আমার কাছে বরং, ব্যাপারটা উল্টোই মনে হয়।
রাজনীতি ব্যাপারটা আমার কাছে অনেকটা একটা প্রতিষ্ঠান (Organization) এর মত মনে হয়। এইটা এমন একটা প্রতিষ্ঠান, যে কিনা সারা দেশকে চালাবার ক্ষমতা রাখে। এটা এমন একটা সিস্টেম, যেখান থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, আমাদের দেশের সকল মানুষের জন্য কিভাবে আমাদের সম্পদ গুলো বরাদ্দ করা হবে। এবং কারা এই সিদ্দ্বান্তগুলো নিয়ন্ত্রণ করবে, সেটাও এই রাজনীতির অংশ। সুতরাং, রাজনীতি খারাপ বলে এই ধরনের বড় ব্যাপারগুলো থেকে আমরা নিজেদের আলাদা করে রাখতে পারিনা। রাখলে বরং সেটা বোকামিই হবে। অনেকটা “আপনার সিদ্বান্ত আমার পছন্দ না, কিন্তু আমার আর কিছু করার নাই” ধরনের বোকামি।
বর্তমান সংসদ সদস্য বা মন্ত্রীরা না থাকলে এই সিস্টেমটাই চলতনা। সিস্টেম না চললে কি হত, সেটা হলফ করে কেউ বলতে পারবেনা। হয়ত এর থেকে খারাপ কিছু হইত, অথবা ভাল কিছু হইত। কিন্তু যতদিন পর্যন্ত সেইটা না হচ্ছে, ততদিন পর্যন্ত বর্তমান সিস্টেমটা যারা চালাচ্ছে, তাদেরকে অন্তত একটা ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। কারণ, অনেক অনেক মেধাবীরা, এই জিনিশটা নোংরা অপবাদ দিয়ে, এখানে আসতে চায়না। আর এই রকম নোংরা জিনিস জেনেও যারা এখনও এইখানে আছে, তাদের খারাপ কাজগুলো বাদে, শুধুমাত্র দায়িত্ব নেওয়ার জন্য হলেও তারা অবশ্যই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।
দেশ পরিচালনা করা সহজ ব্যাপার নয়। গণতন্ত্র নিয়ে একটা কথা অনেকেই বলেন “Democracy is not the right solution, but no one has implemented a better one yet”। রাজনীতি ব্যাপারটাও তেমনি যথেষ্ট জটিল। শতশত মানুষের উপর একটা সিদ্বান্ত নেওয়ার সময় অনেক চিন্তা ভাবনা করে নিতে হয়। এটা ঠিক যে বেশিরভাগ সময়, দুর্নীতির কবলে পড়ে সঠিক সিদ্বান্ত নেওয়া হয়না। এই জায়গাটাতেই অনেকের আপত্তি থাকে, কেন এই রকম একটা পদে থেকে একটা মানুষ দুর্নীতি করতে পারে! দুর্নীতি করা অবশ্যই খারাপ। সেখানে কোন দ্বিমত নেই। এখানে আমার মুল কথা হচ্ছে, কেউ যদি দুর্নীতি নাও করতে চায়, সেইটা দেখা যাবে দুর্নীতিগ্রস্থ সিস্টেমের কারণে সৎ থাকা সম্ভব হয়ে পড়েনা। এবং দুর্ভাগ্যবশত, ঐতিহাসিক কারণে ( Historical Reason ), আমাদের সিস্টেমটা ইতোমধ্যে দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে বসে আছে। সেকারণে, এইখানে গুটিকয়েক লোক এসে হুট করেই সব পরিবর্তন করে ফেলতে পারবেনা।
এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যাবে, তাহলে কি আমরা আমাদের প্রতিনিধিদের ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানাবোনা ? ভুল সিদ্বান্তের প্রতিবাদ অবশ্যই জানাতে হবে। সেটা করার দুটো উপায় আছে –
- সিস্টেম গ্রহণ করবে এমন কোন উপায়ে চেষ্টা করা। ব্যাপারটা সময়সাপেক্ষ এবং জটিল হলেও আমাদের সিস্টেমে এটাই একমাত্র পদ্ধতিগত সমাধান। যেমন, কোন কাজে সাহায্য না পেয়ে কাস্টমার সার্ভিসে কল করা। অথবা বিভিন্ন অধিকার আইন অনুযায়ী মামলা করা।
- বিদ্রোহ করা। বিদ্রোহ সফল হলে সেটার ফল অনেক দ্রুতই আসে, কিন্তু সফল করতে যে পরিমাণ সক্রিয়ন শক্তি লাগে, সেটা সবসময় থাকে না। এই কারণে খুব কম সংখ্যক বিদ্রোহই এ পর্যন্ত সফল হয়েছে। আমাদের ‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধও অনেকটা এরকম একটা সফল বিদ্রোহ।
সে যাই হোক, বিদ্রোহ করার সময়, অনেকেই বলে ফেলেন, যে অমুক পদে বসে তমুক যা ইচ্ছা তাই করছেন। আরে বাবা, অমুক পদে তো সে এমনি এমনি বসেনাই, হয় আমরাই ভোট দিয়ে তাকে বসিয়েছি, অথবা সে ফাকা মাঠে গোল দিয়েছে। মাঠ ফাকা না থাকলে হয়ত পরিস্থিতি ভিন্ন হতে পারত। তাই, এই ক্ষেত্রে মাঠ কিভাবে ফাকা না রাখা যায়, সেদিকে লক্ষ্য রাখা খুব গুরুত্বপুর্ন।
রাজনীতি আমার কাছে একটা সেলফ ব্যালাঞ্চড সিস্টেম মনে হয়। এই ধরনের সিস্টেম, স্বয়ংক্রিয় ভাবে “সিস্টেমকে নষ্ট করতে পারে” এমন লোককে সিস্টেমের উপরে উঠতে দেয়না। অথবা, যাদেরকে উপরে উঠতে দেয়, তারা ততদিনে “সিস্টেম নষ্ট করা যাবেনা” এই ধারনায় খাপ খেয়ে নেয়। আসল কাহিনী হয়, দিনের পর দিন ধরে এই লুপ চলতে থাকে। এই লুপকে ভাঙতে হলে, আস্তে আস্তে ভাল মানুষদের সিস্টেমে ঢুকতে হবে (বিগত কয়েক বছরে এই ব্যাপারটা হচ্ছে)। অল্প অল্প করে সিস্টেমকে তৃনমূল পর্যায় থেকে বিশুদ্ধ করার এই পদ্ধতি আমাদের সিস্টেমে লম্বা সময়ে ভাল প্রভাব ফেলতে বাধ্য।