— সাইফাই গল্পের গুষ্টি কিলাই —
৩০১৭ সালের একদিন বিকাল বেলা। টুম্পাদের স্কুল ছুটি হয় বিকাল তিনটার সময়। টুম্পাদের এই স্কুলটা আজব একটা স্কুল। অবশ্য পৃথিবীর বাইরে এরকম স্কুল এটাই প্রথম।
প্রতিদিন পৃথিবী থেকে কয়েকটা সোলার সিস্টেম পেরিয়ে অন্য একটা গ্রহে গিয়ে ক্লাস করা একটু ঝামেলাই বটে। কিন্তু টূম্পার অভ্যাস হয়ে গেছে। এই স্কুলটাতে অনেক মজা আছে। টুম্পার বাসা থেকে স্কুলটা খুব কাছে। ওর বাসার দুই ব্লক সামনেই স্পেস শাটলের স্টেশন আছে। একটা স্পেস শাটলে উঠে কয়েক মিনিটেই সাই করে চলে আসা যায়। কয়েক আলোকবর্ষ দুরের গ্রহে এরকম দ্রুতগতিতে চলার ব্যাপারটা, এখন থেকে হাজার বছর আগে পুরাপুরি অবিশ্বাস্য ছিল। কিন্তু বিজ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে মানুষ যে কত এগিয়ে গেছে, সেটা এই স্পেস শাটলগুলো না দেখলে বুঝা যেত না।
পৃথিবী ছাড়াও আরও পনেরটা গ্রহ থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা আসে এখানে ক্লাস করতে। অন্য যারা আসে, ওরাও বেশ মজার। মিটকিট গ্রহ থেকে দুইটা রোবট আসে ওদের সাথে পড়তে। পিটাপাস গ্রহ থেকে কয়েকজন আসে। এদের একজনের আবার তিনটা চোখ। এটা নিয়ে যদিও ওর অন্য বন্ধুরা হাসাহাসি করে, কিন্তু টূম্পা কখনও এগুলো নিয়ে হাসাহাসি করে না। কারন টূম্পা জানে যে পৃথিবী ছাড়াও অন্য গ্রহের যারা আছে, তাদের একেকজন একেক রকম হবে, এটাই স্বাভাবিক। এতে হাসির কিছু নেই।
তো পৃথিবী’র কাছাকাছি যে গ্রহ থেকে ওদের স্কুলে সবথেকে বেশী পড়তে আসে, সেটার নাম রুকারিয়াস। রুকারিয়াস গ্রহে টুম্পা’র এক বন্ধু আছে, ঝিরি নাম। ঝিরি ওদের ক্লাসেই পড়ে।
একদিন টূম্পা দেখল, ক্লাশরুমের বারান্দায় ঝিরি বেশ মন খারাপ করে দাঁড়িয়ে আছে। টুম্পা গিয়ে জিজ্ঞেস করল – “কি ব্যাপার, মন খারাপ নাকি?” ঝিরি বলল – “নাহ, তেমন কিছু না।” টুম্পা তো বেশ বুদ্ধিমতি মেয়ে। বুঝল যে আসলেই ঝিরি’র কিছু একটা হয়েছে, কিন্তু সে হয়ত বলতে পারছে না। তখন টুম্পা বলল – “তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে, তুমি কিছু একটা নিয়ে খুব চিন্তায় আছ।”
টুম্পার এরকম কথা শুনে, ঝিরি ভাবল, আচ্ছা টূম্পাকে তো ব্যাপারটা বলাই যায়। তারপর সে বলতে লাগল তার দুশ্চিন্তার কথা। ঝিরিদের গ্রহে একটা নতুন সমস্যা হয়েছে। অনেক অনেক মানুষ হৃদপিণ্ড বন্ধ হয়ে মারা যাচ্ছে। কেন এরকম হচ্ছে, ওখানকার ডাক্তাররা ব্যাপারটা ধরতে পারতেছে না। গত কয়েক মাসে এই অসুখে আক্রান্ত লোকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে।
ব্যাপারটা যে খুবই ভয়াবহ, টুম্পা সেটা অল্প শুনেই বুঝতে পারল। কিন্তু কি বলবে সেটা বুঝতে পারতেছিল না। তারপরও সে ঝিরিকে বলল – “তুমি চিন্তা করনা, কিছু একটা সমাধান নিশ্চয়ই বের হবে”। এই বলে টূম্পা আবার ক্লাসের ভিতরে ফেরত আসল। কিন্তু টূম্পার মাথা থেকে ব্যাপারটা যাচ্ছিল না। রাত্রিবেলা ঘুমাতে যাবার আগে, বাবাকে সে জিজ্ঞেস করল –
– বাবা, হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেলে কি হয় ?
– হৃৎপিণ্ড বন্ধ হয়ে গেলে মানুষ মারা যায়।
– কেন মারা যায়?
– কারন, তখন শরীরের বিভিন্ন যায়গায় রক্ত পাঠানোর মতো কেউ থাকেনা।
– রক্ত পাঠানোর মতো কেউ থাকেনা কেন?
– কিভাবে থাকবে, যে হৃৎপিণ্ড রক্ত পাঠাত, সেটাতো বন্ধ হয়ে গেছে।
– আচ্ছা। তাহলে আর একটা হৃৎপিণ্ড বসিয়ে দেওয়া যায়না?
– সেটা তো অবশ্যই যায় মা। কিন্তু আর একটা হৃৎপিণ্ড কোথায় পাবে তুমি ?
– তা তো জানিনা। ডাক্তাররা চাইলে বানাতে পারবেনা ?
– চাইলে হয়ত পারবে। সেটার জন্য অনেক গবেষণা করতে হবে।
পরদিন সকালে উঠে খাইদাই করে টুম্পা স্কুলের দিকে রওয়ানা হল। বাসার সামনে ষ্টেশনে পৌছুতে না পৌছুতেই স্পেস শাটল এসে হাজির। তাড়াতাড়ি উঠে জানালার পাশের একটা সিটে বসে পড়ল। আর ভাবতে লাগল আজকে ক্লাসে গিয়ে ঝিরিকে জিজ্ঞেস করতে হবে কি অবস্থা। স্পেস শাটল যখন স্কুলের সামনের স্টেশনে থামল, টুম্পা নেমে প্রথম গেট দিয়ে বের হল। বের হবার সময় দেখল দেখল ওদের বায়োলজি’র শিক্ষকও যাচ্ছে। স্যারকে দেখে টূম্পা জিজ্ঞেস করল –
– স্যার, কেমন আছেন ?
– আরেহ, টূম্পা। আমি ভাল আছি। তুমি কেমন আছ?
– আমিও ভাল আছি স্যার। আচ্ছা, আপনার কাছে আমার একটা ব্যাপার জানার ছিল।
– হুমম, খুব গুরুত্বপুর্ন ব্যাপার মনে হচ্ছে, বল।
– না না, তেমন কিছু না। আপনি কি জানেন হৃৎপিণ্ড কিভাবে বানায় ?
– কেন, হঠাত এই প্রশ্ন ?
– নাহ, মনে হল, যদি কারও একটা হৃৎপিণ্ড নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কি সেটা বদলে আর একটা বসিয়ে দেওয়া যাবে ?
– হ্যা, অবশ্যই যাবে।
স্যার, আরও কি যেন বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু ততক্ষণে স্টেশন থেকে ওরা হাঁটতে হাঁটতে স্কুলের সামনে চলে এসেছে। স্যার তখন একটু থেমে টূম্পাকে বলল যে তার এখন একটা ক্লাস আছে, পরে একসময় বিস্তারিত বলবে। টূম্পার একটু মন খারাপ হল, এভাবে অর্ধেক শুনে ব্যপারটা হজম হচ্ছিল না ঠিক। আবার স্যারের ও তো ক্লাস আছে। যাই হোক, টূম্পা নিজের ক্লাসে চলে গেল।
ক্লাসে ঢুকেই ঝিরিকে দেখতে পেল সামনের বেঞ্চে বসে আছে। ওর নিজের জায়গায় ব্যাগ রেখে, ঝিরি’র কাছে এসে জিজ্ঞেস করল –
– তোমার গ্রহের এখন কি অবস্থা?
– তেমন ভাল না। তবে আজকে সকালে একটা নতুন খবর শুনলাম।
– কি খবর ?
– আমাদের গ্রহ থেকে ডাক্তারদের একটা দল কয়েকদিন এর মধ্যেই পৃথিবীতে আসবে।
– তাই নাকি। কেন, পৃথিবীতে কি আছে ?
– সেটা ঠিক বলতে পারছিনা। সকাল বেলা স্কুলের জন্য রেডি হতে হতে পরের খবরটুকু আর শোনা হয়নি।
– হুমম।
টূম্পা হুমম বলে কিছুক্ষণ ধরে চিন্তা করতে লাগল। রুকারিয়াস গ্রহ থেকে ডাক্তারদের দল পৃথিবীতে আসতে পারে কি কারনে! আমাদের এখানে আসলে কি আছে! তাছাড়া পৃথিবী ছাড়াও অন্যান্য গ্রহে অনেক উন্নত যন্ত্রপাতি থাকতে পৃথিবীতেই কেন আসছে! এরকম চিন্তা করতে করতে ততক্ষণে ওদের টিচার চলে আসল ক্লাসে। তারপর ওরাও পড়াশুনায় মনোযোগ দিল।
পরে স্কুল শেষে বের হতে যাবে, পিছন থেকে একজন ডাক দিল –
– এই টূম্পা, তুমি না হৃৎপিণ্ডের ব্যাপারে শুনতে চেয়েছিলে। চল তোমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলি।
– ওহ স্যার, আমি ব্রেক টাইমে আপনার সাথে দেখা করতে ভুলেই গিয়েছিলাম। জ্বি চলেন।
– শোন, পৃথিবীর ডাক্তারেরা অনেক আগেই এই সমস্যার সমাধান করে ফেলেছে।
– তাই নাকি! কিভাবে ?
– হ্যা। এখন থেকে প্রায় হাজার বছর আগে বাংলাদেশের এক বিজ্ঞানী তার দল নিয়ে গবেষণা করে কৃত্তিম ফুসফুস আবিষ্কার করেছিল।
– তাই নাকি!
– হ্যা, বাংলাদেশের এক স্কুল থেকে পড়াশুনা করেছিল সে। তারপর কলেজ, ইউনিভার্সিটী পার হয়ে আরও উচুমানের পড়াশুনাও শেষ করে ফেলল! সেই উচু মানের পড়াশুনার এক পর্যায়ে সে তার দল নিয়ে কৃত্তিম ফুসফুস নিয়ে কাজ করেছে।
– তারপর কি হল স্যার ?
– বিজ্ঞানী টুম্পার সেই গবেষণাকে কেন্দ্র করে আরও অনেক বিজ্ঞানীরা কাজ করেছে পরে। এই কাজগুলোতে এগিয়ে যাওয়ার কারনেই তো পৃথিবীতে ফুসফুসের রোগে এখন মানুষ মৃত্যুর হার অনেক কম।
– আমার কাছে তো অবিশ্বাস্য লাগছে, সত্যি বলছেন তো স্যার ?
– সত্যি সত্যি। তবে, সব থেকে মজার ব্যাপার কি জান?
– কি ?
– বাংলাদেশের সেই মেয়ের নামের সাথে কিন্তু তোমার নামের মিল আছে। তার নাম ছিল আয়েশা আরেফিন টুম্পা। লোকজন তাকে “বিজ্ঞানী টূম্পা” নামে ডাকত।
এরকম একটা খবর শুনে স্কুলে পড়া টুম্পা যেন আকাশ থেকে পড়ল। আসলে টুম্পা যতটা না অবাক হয়েছে, তার চেয়ে বেশি খুশি হয়েছে। দুইদিন পরে ঝিরি’র কাছ থেকে সে এ ব্যাপারে আরও বিস্তারিত শুনল। রুকারিয়াস গ্রহ থেকে যারা এসেছিল, তারা আসলে পৃথিবীর কেন্দ্রীয় গবেষণাগার এর বিজ্ঞানী’দের কাছে এসেছিল। আয়েশা আরেফিন টুম্পা’র আবিষ্কার করা তত্বটাই ওরা ফুসফুস এর বদলে কৃত্তিম হৃৎপিণ্ড বানানোর জন্য ব্যবহার করবে।
পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের কাছ থেকে এরকম সাহায্য পেয়ে রুকারিয়াস গ্রহের বিজ্ঞানীরা খুবই আশাবাদী। ইতোমধ্যে রুকারিয়াস গ্রহ থেকে তাদের প্রধানমন্ত্রী পৃথিবীর মানুষের প্রতি ধন্যবাদ বার্তা পাঠিয়েছেন।
টুম্পা যতবারই এই খবরটা টিভিতে দেখে, ততবারই ওর সেই হাজার বছর আগের বিজ্ঞানী টূম্পার কথা মনে হয়। বাংলাদেশ থেকে এত বছর আগে এক মেয়ে কিভাবে এরকম আবিষ্কার করার মত বড় একটা কাজ করে ফেলল! এই ধরনের কাজগুলো যে পৃথিবীকে কত দুরে এগিয়ে নিয়ে যাবে, সেটা চিন্তা করতেই মনে মনে একটা আত্মবিশ্বাস পায় টুম্পা। ভাবে, বড় হয়ে সেও এক সময় বিজ্ঞানী টুম্পার মত দেশের মানুষের জন্য, পৃথিবীর মানুষের জন্য অনেক কিছু করতে পারবে 🙂
Leave a Reply