আসার আগে, পর্যন্টন কেন্দ্রে একবার ঢু মেরেছিলাম। ওখান থেকে বলেছে, এই জঙ্গল আর এর আশেপাশের এলাকাগুলো অভয়ারণ্য হিসেবে মার্ক করা। তাই যেকোন কিছুই থাকতে পারে। আমরা অবশ্য ওভাবেই প্রস্তুতি নিয়ে এসেছি। দশ-বার জন মানুষ আছি, প্রত্যেকের সাথেই ধারাল কিছু না কিছু আছে।
এই জঙ্গল নিয়ে রিসেন্ট যত ট্রাভেল ব্লগ আছে, সবগুলাতেই চোখ বুলিয়ে এসেছি। রিসেন্ট টাইমে কেউই তেমন হিংস্র কিছুর দেখা পায়নাই। বনবিড়াল আর হাতিই মোটামুটি সবার চোখে পরে। সর্বশেষ বছর আটেক আগে একজন নাকি একটা বাঘ দেখেছিল। সে কবেকার কথা, সেই বাঘ এতদিনে শিউর মরে ভুত হয়ে গেছে।
পাহাড়ি ট্রেইল ধরে হাঁটতে হাঁটতে আমরা একেবারে মাথায় চলে আসছি। গাছ গাছালির ভিতর দিয়ে হাঁটতে অবশ্য খারাপ লাগেনাই। তবে শেষের দিকে খাড়া কিছু উঁচু জায়গায় সবার ভালই কাহিল অবস্থা গেছে। এতক্ষণ ধরে হাঁটার পরে কষ্টগুলা, এই জায়গায় এসে সবাই ভুলে গেছে। উপর থেকে দুরে কয়েকটা পাহাড়ের চুড়া দেখা যাচ্ছে। আর মাঝের জায়গাটা ছেড়া ছেড়া মেঘের অংশ দিয়ে ভরা। মনে হয় কেউ হাতে ধরে একটা ছবির উপরে মেঘগুলো বসিয়ে দিয়েছে।
আমরা যে জায়গাটায় আসছি এইখানে বেশ কয়েকটা বড়বড় পাথর আছে। ঠিক করলাম, আজকে রাত এইখান এই ক্যাম্পিং হবে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলাম, জায়গাটা একটু স্যাঁতসেঁতে। কিন্তু পাথরগুলার সাইড করে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা আছে। আমরা কয়েকজন মিলে সেখানটা পরিষ্কার করে তাঁবু বসাতে লেগে গেলাম। তাঁবু সেট করা কঠিন কিছু না। তাঁবুর কাপড় রোল করা থাকে নরমালই। ভাল করে রোল করা থাকলে, সেটা খুলে তাঁবু সেট করতে দু মিনিটও লাগে না।
এর মধ্যে দুইজন লেগে গেল বার-বি-কিউ করার জন্য। মাংসের প্যাকেট কয়েকজন এর কাঁধে অল্প অল্প করে আগে থেকে ভাগ করে দেওয়া আছে, যাতে একজনের উপরে বেশী ভার না পরে। প্যাকেট থেকে ওগুলো বের করে একটা বাটিতে এক করা হল। ওদিকে কিছু ডালপালা দিয়ে আগুণ জ্বালানোর মত করে জড়ো করা হল। যদিও একটু ভিজা ভিজা, তারপরও ব্লোয়ার আর ফায়ার-এনহ্যাঞ্চার থাকাতে আগুণ ধরাতে সময় লাগল না।
বারবিকিউ যতক্ষণে হয়ে এসেছে, ততক্ষণে সবার পেটের অবস্থা চো চো। সারাদিন হাটাহাটির পর ক্ষিদে লাগাটাই স্বাভাবিক। আগুণের উপর থেকে যখন মাংসগুলা এক এক করে নামানো হচ্ছিল, নামাতে যতটুকু সময়, পেটের ভিতরে চালান করে দিতে মনে হয় কোন সময়ই লাগল না :p আর সাথে ছিল পাউরুটী। এর মধ্যে একজন আবার খুশিতে গান শুরু করল। এই রকম আকাশের তারা দেখতে দেখতে আর বারবিকিউ খেতে খেতে গান গাওয়ার বেপারটা অনেকদিন ধরে মিস করতেছিলাম। এবারের ট্রিপে সেই আশাটা পুর্ন হয়ে গেল 🙂
আড্ডা চলল আরও ঘণ্টা খানেক। এর ভিতরে ঘুম পেয়েছে অনেকেরই। ক্যাম্পিং এ বিছানা সেট করে সবাই ঘুমুতে চলে গেছে, আমি কি কারনে যেন একটা পাথরের উপর বসে ঘাস চিবাচ্ছিলাম। হঠাত করে দেখলাম একটা চিতাবাঘ একটা তাঁবুর পাশে ঘুরঘুর করতেছে। ড্যাম ইট! আমি তারায়ে দেওয়াড় জন্য জোড়ে হুস করে শব্দ করলাম। এবং সাথে সাথেই বুঝতে পারলাম, কত বড় ভুল করে ফেলছি।
বাঘটা আসলে চলেই যাচ্ছিল, আমার শব্দ শুনে পিছনে ফিরল। আমার দিকে কটমট করে তাকিয়ে আছে, মনে হচ্ছে কত ভালবাসা। ভালবাসার গুষ্টি কিলাই, আমি পাশে একটা গাছ ছিল, সেটার একটা ডাল বেয়ে উপড়ে উঠার চেষ্টা করলাম। কিন্তু ঝামেলা হইতেছে, ডাল ধরে পা উপড়ে উঠাতে পারছিলাম না, কেমন যেন শক্তি নাই। সারাদিনে ট্র্যাকিং কম হয়নাই। পা আর একটা ডালের উপর উঠাতে পারলেই আপাতত নিচ থেকে বাঘটা আর ছুতে পারবে না।
অনেক কষ্টমস্ট করে গাছে উঠলাম, কিন্তু কিসের কি, চিতাবাঘটাও ওইদিক থেকে আর একটা গাছের একেবারে মাথায় উঠে গেছে। আমার আর বাঘটার মাঝে আরও একটা গাছ আছে। দেখলাম চিতাবাঘটা চেষ্টা করতেছে লাফ দেবার। দূরত্ব যতটুকু, তাতে ভালমতো লাফ দিলে আমার ঘাড়ে এসে পড়ার ভাল সম্ভাবনা আছে।
কি করব বুঝতে পারছিলাম না। চিৎকার করে বাকি সবাইকে ঘুম থেকে তুলাটা ঠিক হবে কিনা, নাকি ওদেরকে দেখে ওদের উপরও চড়াও হতে পারে। বাঘটা এতক্ষণে ভাল একটা পজিশনে দাঁড়িয়ে গেছে। এরপর এদিক সেদিক নড়াচড়া করে সে লাফ দিয়েই দিল। আমি দেখতে পেলাম, বাঘটার মুখ বড় হা করে এগিয়ে আসছে, চোখা চোখা দাঁতগুলো থেকে ঝিলিক আসতেছে। আমার আত্মা ততক্ষণে জমে বরফ হয়ে গেছে। বাঘের সামনের হাতের নখর গুলো স্লো মোশনে আমার গালে খামচি মারার ঠিক আগ মুহুর্তে ঘুমটা ভেঙ্গে গেল।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি রাত তিনটা বাজে। এখন না ঘুমালে কালকে সকালে ট্রিপের বাস শীউর মিস হবে। ল্যাপটপটা পাশে রেখে, লাইট নিভিয়ে বালিশটা ঠিক করে নিলাম 🙂