সামাজিক মূল্যবোধ ব্যাপারটা আসলেই সামাজিকভাবে আসে। অনেকের ক্ষেত্রে সেটা পরিবার থেকে, কারও ক্ষেত্রে স্কুল থেকে, কারও ক্ষেত্রে পরিচিত অন্যান্য মানুষ থেকে।
সাম্প্রতিক ঘটনা সমুহের ভিত্তিতে বলা যায় যে বর্তমান সময়ে মুল্যবোধ ব্যপারটা কিছু কিছু ক্ষেত্রে কমে গেছে। আমাদের দেশকে এগিয়ে নিতে হলে আসলে এই মূল্যবোধটা বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই। আমি যদি মনে করি আমার বাসা থেকে ময়লা নিয়ে রাস্তায় ফেলে দিলেই আমার বাড়ি পরিষ্কার হয়ে গেল, তাহলে সেটা ভুল হবে। বরং সে ময়লাগুলো কিছুক্ষন পরে বাতাসে আবার আমার বাসাতেই হাজির হবে।
ব্যপারটা এমন না যে, ধরে কয়েকজনকে শাস্তি দিয়ে দিলাম, সমাধান হয়ে গেল। এটা একটা অস্থায়ী সমাধান। এটারও দরকার আছে। নাহলে পরাপর সময়গুলোতে এই ধরনের অঘটনের পরিমান বেড়ে যাবে। তবে সাথে সাথে লম্বা সময়ব্যাপী স্থায়ী সমাধানও দরকার। এখন না হোক ২০ বছর পরে যদি আমরা এমন একটা প্রজন্ম তৈরী করতে পারি যারা ঐ রাস্তাকেও নিজের দেশের একটা অংশ হিসেবে বিবেচনা করবে। হাটতে চলতে রাস্তার পাশে চুইংগাম ফেলতে গিয়েও আর একবার ভাববে। একটা কথা কি, আমাদের দেশের লোকগুলার সবাই যে খারাপ এটা না। বরং অনেকেই অনেক কিছু বুঝে। শিক্ষার হার (A+ এর কথা বলছিনা) আগের থেকে বেড়েছে। অনেকেই হয়ত এটার সাথে একমত হবেননা। কিন্তু আমার মনে আছে, এখন থেকে ১০-১৫ বছর আগে পত্রিকাগুলোতে রম্য লেখা হিসেবে চালে পাথর মিশানোর ব্যপারটা বেশ প্রচলিত ছিল। সেই জিনিসটা এখন বলতে গেলে খুবই কম। ছোটবেলায় শুনতাম রাস্তায় বের হলেই ছেলেধরা ধরে নিয়ে যাবে। সেটাও এখন খুব কমই আছে। অপরাধ যে কমে নাই হয়ে গেছে, সেটা নয়। বলা যায়, মানুষের সচেতনতা বেড়েছে। আগের থেকে অনেক বেশী। আমাদের দেশের যেই মানুষগুলো রাস্তায় হাটতে গিয়ে যেখানে সেখানে কাশি-থুতু ফেলে, সেই একই মানুষগুলো বসুন্ধরা সিটি/যমুনা ফিউচার পার্কে গিয়ে সুন্দর করে ডাস্টবিন/রেস্টরুম খুঁজে বের করে। সমস্যা নাই এটা বলব না। তবে আগে সমাধান করা যতটা কষ্টের ছিল, এখন তার চেয়ে অনেক সহজ। আর সে জন্য চাই ঐ মুল্যবোধ।
যেটা বলছিলাম, বিভিন্ন অঘটনগুলোতে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হলে তার পক্ষে বা বিপক্ষে সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমান লাগে। নাহলে অনুমান বা আবেগের বশবর্তী হয়ে যে কেউ অন্যের নামে অভিযোগ করে দিলে কিছু করার থাকেনা। আর সাথে রাজনৈতিক যোগসুত্রের ব্যাপার তো আছেই। এসবের দিকে চেয়ে যদি আমরা বসে থাকি তাহলে ঠিক বিচার বা সমাধান পেতে অনেক দেরী হয়ে যাবে। আমরা হয়ত অন্য অনেকভাবে চেষ্টা করতে পারি। নতুন প্রজন্মের মাঝে মুল্যবোধের শিক্ষা ছড়িয়ে দিতে হলে একটা উপায় হল পাঠ্যপুস্তকে এগুলোর পরিধি বাড়ানো। এই জিনিসটা আমাদের খুবই দরকার। একজন মানুষ তার আত্ম-চিন্তার বাইরে গিয়ে, সামগ্রিকভাবে দেশের জন্য চিন্তা করবে, এটা মনে করতেই কত ভাল লাগে।যদিও পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি ব্যাপারটা বাস্তবায়িত করা বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যপার, তারপরেও এটা আমাদের করতেই হবে। বেশি কিছু না, চাই একটি চিন্তা – আমি শুধু আমি নই, আমি আমার দেশের একটি অংশ। আমার চেহারায় খালি আমিই নাই, সাথে আছে একটি লাল-সবুজের পতাকা।
সাথে সাথে আরও একটি ব্যাপার যোগ করতে চাই। বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে দারুন একটা ঐতিহ্য চালু হয়েছে। সেটা হচ্ছে অলিম্পিয়াড। গনিত-অলিম্পিয়াড, ফিজিক্স-অলিম্পিয়াড, বায়োলজী-অলিম্পিয়াড। গত বছর থেকে শূরু হয়েছে বিজ্ঞান কনগ্রেস। এরকম বেশ কয়েকটি উদ্যোগ ইতোমধ্যে আমাদের নতুন প্রজন্মে বেশ সাড়া ফেলেছে। এগুলোর পিছনের কলাকুশলী আর স্বেচ্ছাসেবকদেরও অক্লান্ত পরিশ্রম কারনেই এটা সম্ভব হয়েছে। সবচেয়ে বড় কথা স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েরা বেশ আগ্রহ নিয়েই এগুলোতে অংশগ্রহন করছে। বর্তমানে কেবল এই ধরনের জাতীয় আয়োজনগুলোই দেশের এতগুলো জেলার নতুন প্রজন্মের কাছে একসাথে পৌছাতে পেরেছে। আমরা কি এই সুযোগটা কাজে লাগাতে পারি না! এই রকম আয়োজনগুলোতে কি আমরা ১৫ মিনিট সময় মুল্যবোধের জন্য রাখতে পারি? আমি মনে করি যারা এই আয়োজনগুলোর সাথে জড়িত আছেন, তারা একটূ চিন্তা করলেই হয়ত ১৫ মিনিটের জন্য কিছু একটা ভিন্ন আইডিয়া বের করে ফেলতে পারবেন। হতে পারে কোন প্রেজেন্টেশন, হতে পারে কোন অ্যানিমেশন, হতে পারে কার্টুন বা তথ্যচিত্র। লক্ষ্য একটাই “আমি শুধু আমি নই, আমি মানে আমার দেশ” এই ব্যাপারটা ছড়িয়ে দেওয়া।
সবশেষে বলব, মুল্যবোধ জিনিসটা এমনি এমনি হয়না। এর জন্য উদ্যোগ নেওয়া লাগে। আমার ভিতরে যদি সামান্যতম মূল্যবোধ থেকে থাকে, আমি বলব সেটা আমি পেয়েছি আমার পরিবার থেকে। আমার বাবা-মা’র কাছ থেকে। আমার চাচা/খালা স্কুলের শিক্ষক ছিলেন, তাদের কাছ থেকে। আমার স্কুল-কলেজের স্যারদের থেকে। আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে গিয়ে পড়া ঈশপের গল্পের বই আর নানুবাড়িতে ট্রাঙ্কের ভিতর থেকে বের করা চয়নিকা বই থেকে। মোট কথায় আমরা যে পরিবেশে বড় হয়েছি, সেটাই আমাদেরকে এই ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবতে শিখিয়েছে। আর তাই আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত, পরবর্তী প্রজন্মকে যেন আমাদের থেকেও ভাল একটা পরিবেশ আমরা তৈরী করে দিতে পারি। দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠগুলোতে যদি এরকম অঘটন হয়, তাহলে বুঝতে হবে আমাদের শিক্ষাদানে কোন এক জায়গায় ছোট ফুটো আছে। হয়ত সেই ফুটোর কারনেই আমরা সাম্প্রতিক অঘটনগুলো দেখতে পাচ্ছি। সামগ্রিকভাবে যদি কয়েকটা প্রজন্মের মধ্যে আমরা এই মুল্যবোধগুলো তৈরী করে ফেলতে পারি, তাহলে মনে হয় গত ৪৪ বছরে যতটূকু আগাতে পারিনি, আগামী ২০ বছরে তার থেকে দিগুন এগিয়ে যাবো।